আমার বিদ্যালয়ের কিছু স্মৃতি

ডক্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মিঝি
বি.এস. এস (অনার্স), এম. এস. এস (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম)
পি.এইচ.ডি
সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

পরম করুনাময় মহান আল্লাহ তা’আলার নামে শুরু করলাম। সমস্ত প্রসংশা মহান আল্লাহ তা’আলার এবং অসংখ্য দরুদ ও ছালাম আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর উপর।
১৯৮৫ সালের পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ৭ম স্থান অধিকার করে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমার প্রিয় বিদ্যালয় ”পাঠান নগর অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়” ভর্তি হই। ছাত্র জীবনের প্রথমে তেমন ভাল ছাত্র ছিলাম না। বসবাস করতাম এক অজ পাড়া গ্রামে যেখানে ছিল না কোন আধুনিক সুযোগ সুবিধা- ছিল না বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট। একটা আইল এর ন্যায় ছিল কালাকাজী সড়ক যার উপর দিয়ে যাতায়াত করতাম প্রতিদিন স্কুলে। রাস্তায় ছিল অনেক গর্ত- এমন কি কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসেও রাস্তায় কর্দমাক্ত পানি থাকত। স্কুলের দূুরত্ব ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১.৫ কিমি। আমাদের সময় বর্ষা মৌসুমে বন্যা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেক সময় বন্যার কারণে আমরা পানি বন্ধি হয়ে বিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতাম সপ্তাহ খানেক। প্রায়শঃ পরনের জামা-কাপড় ভিজিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ১.৫ কি. মি. কর্দমাক্ত রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতাম। খুব বেশি বৃষ্টি হলে আশ্রয় নিতাম পাশ্ববর্তী কোন বাড়িতে। তৎকালীন সময় আমরা বেশির ভাগ সহপাঠী লুঙ্গী পরে খালি পায়ে স্কুলে যেতাম, কেননা আমাদের সময় আমরা অনেকেই ছিলাম গরিব কৃষক অথবা ছোট-খাট সরকারি চাকুরিজীবীর সন্তান। বর্তমানের ন্যায় এত প্রবাসী ছিল না। তখন প্রবাসী বলতে করাচী প্রবাসীদের বুঝানো হত।

বাবা যদিও সরকারি চাকুরি করতেন, যে টাকা পাঠাতেন সেই টাকা দিয়ে আমাদের ৫ ভাই-বোনে নিয়ে গঠিত পরিবার চালানো মায়ের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া কিছুটা মা তদারকি করতেন, কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় উঠার পর লেখাপড়া তদারকির জন্য গৃহ শিক্ষক বা অন্য কেউ ছিলনা। তবে দাদার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও খোঁজ খবর রাখতেন- কি পড়তেছি, কি করছি, কোথায় যাচ্ছি? মুখে মুখে শিখিয়েছেন অনেক নীতি বাক্য, কোরআন-হাদিস, নবী-রসুল এবং আউলিয়া কেরামের জীবন কাহিনী।

বিদ্যালয়ে যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম, একদিন আমাদের একজন শ্রদ্বেয় শিক্ষক ইংরেজী গ্রামারের (চধৎঃং ড়ভ ঝঢ়ববপয) পড়া শিখে আসতে বলেছিলেন, কিন্তু আমরা কয়েকজন পড়া শিখতে পারিনি; যার জন্য স্যার আমাদেরকে শাসিয়েছিলেন। উনি যখন আমাকে শাসাচ্ছিলেন তখন বললেন, ”তোমরা ঝড়সব ঝড়সব লেখাপড়া করে চলে যাবে”।

৬ষ্ঠ শ্রেণি হতে যখন ৭ম শ্রেণিতে উওীর্ণ হই, তখন আমি ৩য় স্থান অর্জন করি। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, পাঠান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করি ১৯৮১ সালে। এ সময় হতে আমার দুই সহপাঠী সবসময় ১ম ও ২য় স্থানে থাকতো। এই শক্ত জুটিকে অতিক্রম করা ছিল খুবই দুুরূহ ব্যাপার। তখন আমি ইংরেজিতে তেমন ভাল ছিলাম না, গণিতে ছিলাম খুব বেশি দূর্বল। গণিতে আমার দূর্বলতা এমন পর্যায় পৌঁছাত যে, অনেক সময় ৩৩ নম্বর নিয়ে পাশ করতে হত। ৭ম শ্রেণি হতে যখন ৮ম শ্রেণিতে উওীর্ণ হই তখন আমি ৩য় স্থান হতে ৫ম স্থানে চলে যাই। কিছুটা কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু উপায় নেই। গণিত সবসময় আমার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ৮ম শ্রেণি হতে যখন ৯ম শ্রেণিতে উওীর্ণ হই তখন আমি ২য় স্থান দখল করি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমার যে সহপাঠী ১ম শ্রেণি হতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ২য় স্থানে থাকত সে ৮ম শ্রেণির বছর ঢাকায় চলে যায়, সেহেতু ২য় স্থানটা দখল করি সহজে। ৯ম শ্রেণিতে উওীর্ণ হয়ে আমি কলা বিভাগে অর্ন্তভূক্ত হই, আমার সহপাঠী যে ১ম হয়েছে সে অর্ন্তভূক্ত হয় বিজ্ঞান বিভাগে। যেহেতু আমি গণিতে দূর্বল সেহেতু বিজ্ঞান বিভাগ নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা । ৯ম শ্রেণিতে একটাই লক্ষ্য ছিল ১ম হওয়া। সে লক্ষ্যে কিছু দিন আমার এক শ্রব্দেয় শিক্ষকের কাছে গণিত এবং অন্য দুই জন শিক্ষকের নিকট ইংরেজি পড়ি। প্রকৃত পক্ষে গণিত আমার জন্য কঠিন বিষয় ছিল। অংক করতে গিয়ে অনেক সময় কোথাও + (প্লাস) চিহ্ন এবং কোথাও – (মাইনাস) চিহ্ন না দিয়েই অংক মিলিয়ে পেলেছি। অংক আসলে মুখস্তের মতই ছিল, করতে করতে কলম নিজেই রেজাল্ট মিলিয়ে ফেলত।

৯ম শ্রেণি হতে যখন ১০ম শ্রেণিতে উওীর্ণ হই তখন আমি এবং আমার এক সহপাঠী (১ম স্থান অধিকারী) দুইজনই ৬০৭ নম্বর পাই। এখানে আমি হয়ত আরও অনেক বেশী নম্বর পেতাম, কিন্তু পূর্বের ন্যায় গণিত বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কেননা গণিতে পেয়েছি মাত্র ৩৩ নম্বর। যা হোক, আমাকে ১০ম শ্রেণিতে ২য় এবং আমার ঐ সহপাঠীকে ১ম স্থানে রাখা হয়। আমাকে ২য় এবং তাকে ১ম করার সম্ভবত দুইটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সে ১ম শ্রেণি হতে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত ১ম স্থানে ছিল, এই সময়ের মধ্যে কখনো সে ২য় হয় নাই। দ্বিতীয়ত, আমাদের সময় খুব কম ছাত্রই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হত। এছাড়াও কলা বিভাগের ছাত্র যদি ১ম হয় তাহলে বিজ্ঞান বিভাগ সম্পর্কে জুনিয়র ছাত্রদের একটি নৈতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। সম্ভবত উপরোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে স্যারেরা আমাকে ২য় স্থানে রাখেন।

১০ম শ্রেণিতে আল্লাহর রহমতে খুব ভাল ভাবে লেখাপড়া শুরু করি, এমনকি রাত ৩ ঘটিকার সময় উঠেও লেখাপড়া করেছি। এমনভাবে লেখাপড়া শুরু করলাম যে, খাওয়া-দাওয়া এবং নামাজসহ অত্যাবশ্যকীয় কাজ ছাড়া সকল প্রকার কাজ ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেই। ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত বিকেল বেলা ফুটবল খেলতাম, ১০ম শ্রেণিতে উঠার পর এ খেলাটাও ছেড়ে দেই। দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘন্টা লেখাপড়া অভ্যাসে পরিণত হয়। ১০ম শ্রেণিতে টেষ্ট পরীক্ষার সময় শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মরহুম মফিজুর রহমান (হেড স্যার) আমাকে এবং আমার বন্ধু (১ম স্থান অধিকারী) কে স্যারদের ব্যবহৃত পুরাতন দুইটা টেবিল এবং টুল এ বসিয়ে অন্যান্য সহপাঠীদের থেকে আলাদা করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। কেননা, উনি আমার এবং আমার বন্ধুর সাথে প্রতিযোগিতাটা জমিয়ে উঠাতে চেয়েছিলেন। ঐ বছর যে স্যার গণিতের খাতা মূল্যায়ণ করেন তিনি আমার অন্য এক স্যারের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বলেন, ”মিঝি এবার প্রথম হয়ে যাবে কেননা মিঝি এবার গণিতে ভাল করেছে”। আমি পরীক্ষার হলে ছিলাম আর স্যার পরীক্ষার হলের বাহিরে এ বিষয় আলোচনা করছিলেন। স্যারের এই কথোপকথন আমি শুনে পেলি। তখন স্কুল ছিল বাঁশের বেড়া এবং টিনের চালা দ্বারা তৈরি সেহেতু বাহিরের কথোপকথন শুনা কঠিন হয়নি। স্যারের কথা সত্যে পরিণত হয় এবং আমি টেষ্ট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করি।

আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হয় ২৮শে এপ্রিল ১৯৯১। তখন বিদায় অনুষ্ঠানে আমাদের স্যারেরা ছাত্রদের দ্বারা খতম পড়ানোর ব্যবস্থা করতেন। খতমের মধ্যে ছিল দরুদে নারিয়া, কোরআন খতম এবং খতমে ইউনূস। স্যারেরা আমাদেরকে যে দরুদে নারিয়া শিখিয়েছেন তা এখনো আমার মুখস্ত রয়েছে। বিদায় অনুষ্ঠানে তখন প্রায় সময় মোনাজাত পরিচালনা করতেন পাঠান নগর আমিনিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হযরত মাওলানা মরহুম জাফর আহম্দ (রহঃ)। বিদায় অনুষ্ঠানে মানপত্রটা বিদায়ীদের পক্ষে আমি গ্রহন করি। এটা ছিল বড় আনন্দের ব্যাপার। তখন একটা রীতি ছিল যে, দশম শ্রেণির যে ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করবে সে ছাত্র মানপত্র পাঠ করে টেষ্ট পরীক্ষায় যে ছাত্র প্রথম হয়েছে তাকে মানপত্র দেওয়া।

২৮শে এপ্রিল বিকেল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, আমরা বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে আসি। রাত থেকে শুরু হয় প্রবল ঝড়-তুফান, চলতে থাকে সারারাত । বিপদ সংকেত ৩ নম্বর হতে ১০ নং মহাবিপদ সংকেত পর্যন্ত উঠে যায়। সেই প্রলয়ংকরী ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। মারা যায় লক্ষাধিক লোক। এ জন্য আমাদের পূর্ব নির্ধারিত পরীক্ষা (২ রা মে, ১৯৯১) স্থগিত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমাদের পরীক্ষা শুরু হয় (সম্ভবত) আগষ্ট, ১৯৯১। পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে থাকে। এক পর্যায় সরকার পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয় (সম্ভবত) সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ । সকাল বিকাল দু বেলাই পরীক্ষা হয়। ১৯৯১ সালের এস.এস.সি পরীক্ষায় আমি প্রথম বিভাগ পাই, আমার অন্যান্য বন্ধুরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ পায়। পরীক্ষার রেজাল্টের পর যখন আমি চারিত্রিক সনদপত্র ও মার্কশিট আনতে যাই তখন আমার এক স্যার বলেন, ”মিঝির এবার কোন সমস্যা হবে না, কেননা এইচ.এস.সি হতে আর গণিত বিষয় নেই”।

আমাদের সময় (১৯৮৬-১৯৯১) পর্যন্ত স্কুলের অনেক স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। এর মধ্যে বিশেষ করে আমাদের শ্রদ্বেয় প্রধান শিক্ষক মরহুম মফিজুর রহমান (হেড স্যার) এর নেতৃত্বে তদারকি টিম (ঠরমরষধহপব ঞবধস)। এ টিমের প্রধান কাজ ছিল কাছারী বাজারে বিশেষ করে কোন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে কিনা এবং স্যারের নেতৃত্বে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া, কে সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলে বসেছে, না বাহিরে আড্ডা দিচ্ছে। সকলের অন্তরে একটা ভয় কাজ করতো কখন জানি হেড স্যার চলে আসেন। স্যারদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত।

অনেক সময় কোন স্যার ছুটিতে থাকলে হেড স্যার ঐ ক্লাসে চলে যেতেন যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা বাহিরে ঘোরাঘুরি করতে না পারে অথবা শ্রেণি কক্ষে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে, যার ফলে অন্য ক্লাসের অসুবিধা হয়। কেননা বেড়ার দ্বারা (পার্টিশন) আবদ্ধ এক শ্রেণি হতে অন্য শ্রেণিতে শব্দ যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। একবার সপ্তম শ্রেণিতে এ রকম স্যার ক্লাস নেওয়ার জন্য আসেন। স্যার এসেই বলেন, ”অ ভড়ী ধিং ধিষশরহম রহ ঃযব লঁহমষব” এটি কোন ঞবহংব? তখন আমার এক সহপাঠী গণিতের বইটা এনে দিয়ে বলল, ”স্যার, এখন গণিতের ক্লাস”। স্যার ঐ সহপাঠীর কথায় কর্ণপাত না করে ঞবহংব নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যান। আমার সহপাঠী জেনে শুনেই স্যারকে গণিতের বইটা দিয়েছিল। স্যারের একটা অভ্যাস ছিল যে, যে ক্লাসেই যেতেন সেই ক্লাসে হয়ত বাংলা ব্যাকরণ নয়ত বা ইংরেজি গ্রামার নিয়ে আলোচনা করা। এখন ঐসব বিষয়গুলো মনে পড়লে খুবই লজ্জিত হই। যদিও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি, এখন আমাকে যদি গণিত বিষয় পড়ানোর জন্য বলা হয় তাহলে সেটি আমার পক্ষে পড়ানো সম্ভব হবে না, কেননা আমি সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ের একজন ছাত্র। এমনকি সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় যেমন-অর্থনীতি বিষয় পড়ানোও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

অষ্টম শ্রেণির বছর একদিন আমাদের একজন স্যার ছুটিতে থাকায় হেড স্যার ক্লাসে আসেন। তিনি এসে বলেন, ভাবসম্প্রসারণ কর ”কাঁচাতে না মোড়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস”। তখন এমন বিষয় শুনে আমরা সবাই হেসে ফেললাম এবং পরস্পর কানাঘুষা করলাম এবং মনে মনে বললাম যে, বই পুস্তকে নেই এই কেমন ভাবসস্প্রসারণ। সেটা যে কত দার্শনিক উক্তি তা এখন বুঝতেছি। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে এটা যে কত কঠিন হবে সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে স্যার উক্তিটি করেছিলেন।
আমাদের এক বছরের সিনিয়র যে ব্যাচটি ছিল সেই ব্যাচে অনেক ছাত্র ছিল যারা অনেকেই বয়সে অপেক্ষাকৃত একটু পক্ক ছিল। ঐ ব্যাচ অগ্রণী স্কুলে একটা বড় (Factor) বিষয় ছিল। আমাদের ব্যাচ মোটামুটি শান্ত ছিল; দুই একজন যে দুষ্টামি করতো না তা নয়। তবে সবাই স্যারদেরকে খুব সম্মান ও ভয় করত। বিশেষ করে হেড স্যারের ১ নং কোর্টের ভয়। কোন ছাত্র দুষ্টামি বেশি করলে হেড স্যার উনার ১নং কোর্টে ডেকে নিয় যেতেন এবং দরজা জানালা বন্ধ করে ছাত্রকে শোধরাতেন। বাহিরের ছাত্র ছাত্রীরা ভেতরের শব্দ শুনে যথেষ্ট ভয় পেত। প্রকৃতপক্ষে ১নং কোর্টের উদ্দেশ্য ছিল হেড স্যার এবং সিনিয়র স্যারেরা মিলে যে ছাত্রটা দুষ্টামি করেছে তাকে সংশোধন করা। স্যারদের এ সংশোধনমূলক পদ্ধতির ফলে পরবর্তীতে অনেক ছাত্র নিজেকে সংশোধন করে নেয়।
আমাদের সময় যে পরিবারের সন্তানই হোক না কেন সবাই স্যারদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন। কোন স্যার কোন চা এর দোকানের পাশ দিয়ে হাটতে দেখলেই ছাত্ররা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোকান ছেড়ে পালাতো, বিশেষ করে স্কুলের সময় এবং মাগরিবের নামাজের পর কোন ছাত্রকে চায়ের দোকানে দেখা যেত না। বিশেষ প্রয়োজনে বাজারে আসলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজার ছাড়তে হত। তখন সন্ধ্যার পর বাজারে ছাত্রদের জন্য সান্ধ্য আইন (Curfew) বলবৎ থাকত। স্যারদের Curfew জারি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্ররা যাতে করে মাগরেবের নামাজের পর পড়ার টেবিলে বসে যায়।
স্যারেরা যে ছাত্রদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যাই শিক্ষা দেননি, আর্দশ এবং নৈতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ছিলেন সচেষ্ট। আমাদের সময় একটি রীতি ছিল দুপুরে বিরতির সময় জোহরের নামাজ পড়া। প্রায় সকলেই এ রীতি মেনে চলত। বিশেষ করে তখন জোহরের নামাজে মসজিদের বড় আকর্ষণ ছিল আমিনিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা মরহুম জাফর আহমদ (রহঃ) এবং মৌলভী মরহুম মতিউর রহমান (রহঃ)। এই দুই বুজুর্গ ৪/৫ মিনিটের যে মোনাজাত অথবা নসিহত করতেন তা ছিল ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষার জন্য মহৌষধ।
বিদ্যালয়ের সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি প্রফেসর মোহাম্মদ উল্লাহ (প্রফেসর সাহেব)। তিনি নিজে অগ্রণী স্কুল এবং পাঠান নগর আমিনিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা নিয়েই ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। শুধু যে স্কুলের ব্যবস্থাপনা নয়, অনেক সময় তিনি শ্রেণী কক্ষেও পাঠদান করতেন। একবার ছাত্ররা একজন শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে গুঞ্জন শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য স্যারদের ন্যায় ঐ স্যারও জ্ঞানী ব্যাক্তি ছিলেন। ছাত্রদের গুঞ্জনের কোন যৌক্তিকতা ছিলনা, কারণ ছাত্ররা ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন স্যারের সাথে ০ (শূন্য) বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন স্যারের সাথে তুলনা করেছিল। প্রফেসর সাহেব কিভাবে তা জেনে পেলেন। একদিন দেখি তিনি আমাদের ক্লাসে একেবোরে পেছনের টেবিলে বসে ঐ শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম যে, প্রফেসর সাহেব, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মহোদয় আমাদের ছাত্রদের সারিতে বসে আছেন! বিদ্যালয় নিয়ে প্রফেসর সাহেবের এমন ভাবনা আজও আমাদেরকে লজ্জিত করে। যদিও তিনি সবচেয়ে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, ধন-সম্পদের প্রতি ছিলনা কোন আকর্ষণ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে (আমাদরে জন্মের পূর্বে) মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করে শিক্ষা বিস্তারের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা অতি বিরল। তখন গ্রামে বি.এ পাশ লোক ছিলনা বললেই চলে। আমরা অনেকেই মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছি, কিন্তু কি করতে পেরেছি সমাজের জন্য? আমাদের পূর্বের জ্ঞানীরা সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছেন। বর্তমানে প্রফেসর সাহেব এবং আমাদের স্যারদের নেই তেমন বিত্ত-বৈভব, গ্রামেই জীবন শেষ করছেন। জ্ঞান বিস্তার করাই হচ্ছে উনাদের পেশা এবং নেশা। অন্যদিকে তাকালে দেখি প্রফেসর সাহেব এবং স্যারদের রয়েছে অনেক অর্জন- রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, প্রবাসী, উকিল, শিক্ষক এবং সরকারি কর্মকর্তা। শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে স্মরণ করছি আপনাদের অবদান। তাই আর বেশি কিছু না লিখে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ”উমর ফারুক” কবিতার একটি লাইন দিয়ে শেষ করছি, ”অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দীপাঠ”।

 

“আল্লাহ হাফেজ”

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ