বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রনো ভাই নেই। যদিও জানা ছিল, হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা সত্ত্বেও তার শারীরিক অবস্থায় উন্নতির লক্ষণ নেই,পরিস্থিতি ক্রম অবনতিশীল । কিন্তু আশা মৃত্যুহীন। আগেরবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন । চিকিৎস্যকরা তার জীবন রক্ষার ব্যাপারে ভরসা পাচ্ছিলেন না। সবাই কে তাক লাগিয়ে সেরে উঠলেন। ভেবেছি এবার ও নিশ্চিত হাসপাতাল থেকে ঠিকঠাক হয়ে বাড়ী ফিরবেন। সত্যি বলতে কি, ২০২০ এ দুঃসংবাদ শোনার জন্য আমার মন তৈরী ছিল। জানতাম তার ফুসফুসের একপাশ টা অকেজো এবং অন্য দিকও ক্ষয়ের কবলে। করোনার আক্রমন শ্বাসযন্ত্রে এবং তার বয়স ও প্রতিকুলে ।
২০০৮ কি ২০০৯ । রনো ভাই বললেন ‘তারা ভাই, ডাক্তার বলেছে জীবনের মায়া অথবা ধূমপান, দুয়ের যে কোন একটি ত্যাগ করতে হবে । কাজেই ধূমপানে ইতি, সিগারেট ত্যাগ করেছি।‘ সদিচ্ছা ইতিবাচক,কিন্তু প্রায়ই তা সময়ের বেনো জলে ধুয়ে মুছে যায়। এ ব্যাপারে আমি নিজেই নিজের স্বাক্ষী।
রনো ভাই সামাজিক মানুষ,রাজনীতি করেন।শ্রমজীবী গরিব মানুষের সাথে যোগাযোগ ও মেলামেশা ছাড়া তার রাজনীতি স্থবির,অচল। চা ও সিগারেট এর মত সস্তা ও সহজলভ্য বস্তু লোকের সাথে মেলামেশা ও আড্ডার জ্বালানী স্বরূপ। ধুমপানের শুরু হয় ছাত্র জীবনে ,প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে সে অভ্যাস থেকে মুক্তি কি আর অত সহজে মেলে ! সমাজ দেহকে প্রচলিত সংস্কার মুক্ত করার মতই এও এক দুরূহ মিশন।
ক ‘দিন পর কোন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে শেরাটন হোটেলে সমবেত হয়েছি। লবিতে ধূমপান বারণ।কাজেই এমরান কে বাইরে সিঁড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের গোঁড়ায় আগুন দিতে হলো। দুজন গ্যাজাচ্ছি।আচমকা বিনা নোটিশে রনো ভাই হাজির হয়েই তাড়া লাগালেন,’ এমরান , তুমি খাচ্ছ !কোথায় পেলে! আমাকে একটা দাওতো,টানি।‘ সুখটান শেষে চক্ষু উন্মীলিত হলে লক্ষ করলেন আমার ভ্রূদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত। ত্রস্ত ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , কি ব্যাপার তারা ভাই , বিরক্ত মনে হচ্ছে ?
গম্ভীর কন্ঠে বললাম ’আপনি আবার সিগারেট ধরেছেন ?’
‘কই নাতো? কে বললো? আপনি তো জানেন আমি সিগারেট সেই ক–বে ছেড়ে দিয়েছি।“ তার চোখে মুখে বিশুদ্ধ বিস্ময় ।
আমারই হতবাক হওয়ার পালা ।
‘ রনো ভাই ,আপনার ঠোঁটে সিগারেট এখনো জ্বলছে।“ রনো ভাই আমার কথার মর্ম অনুধাবন করলেন । খুবই বিব্রত ও সলজ্জ্ব ভঙ্গিতে বললেন,“ আমি সিগারেট সত্যি ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে সাঝে ইচ্ছেটা যখন খুব চাগিয়ে উঠে,তখন তেমন কারো সাথে দেখা হলে চেয়ে দু এক টান দেই । নিজে তো কিনি না ।‘
কতটা সফল রণকৌশল,বলা কঠিন । কারণ এরপর ও আমি তাকে ধুম পান করতে দেখেছি।অবশ্য শেষতক সিগারেট ছেড়েছেন ,সেটি আরো পরে।
ঘটনাটি উল্লেখ করার কারণ,বিপ্লবী তাত্ত্বিক হিসেবেই বামপন্থী মহলে রনোভাই এর নামডাক। কিন্তু ব্য়ক্তি রনো ছিলেন সহজিয়া মানুষ,তত্ত্বের মতো জটিল,দুর্বোধ্য ও অনধিগম্য নন ; বরং মিশুক ও খেয়ালী। তার মতো উঁচু পর্যায়ের নেতাদের রীতি হচ্ছে কর্মীদের কাছ থেকে কিঞ্চিৎ ব্যবধান রক্ষা করা । নইলে মাণ মর্যাদা টেকেনা । রনো ভাই এ সবের ধার ধারতেন না । তোপখানা রোডের ওয়ার্কার্স পার্টির সামনে এশিয়া হোটেলের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে প্রফুল্ল চিত্তে হাসিখুশি আমাদের সাথে তুমুল আড্ডায় মেতে আছেন,এ ছবি চোখে ভাসছে।

আড্ডা দেয়ার জন্য রনো ভাই এর মত সঙ্গী মেলা ভার। অফুরন্ত গল্পের এক ভাণ্ডারের মালিকানা ছিল তার। কি সব চরিত্র সে সব গল্পের। মওলানা ভাসানী,শেখ মুজিবর রহমান , অমলসেন ,সুখেন্দু দস্তিদার থেকে শুরু করে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের কমরেড মোজাফফর , সুন্দরাইয়া ,রণদিভে ,প্রমোদ দাস গুপ্ত, জ্যোতি বসু কে নন। এদের সাহচর্য লাভ করেছিলেন তিনি,ছিলেন স্নেহধন্য। ১৯৭১ সালে কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা কাকা বাবুর (কমরেড মোজাফফর) সাথে কোলকাতায় সিপি এম সদর দপ্তরে দেখা হলে খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন,‘ এতো অল্প বয়সে আপনারা সব জাতীয় নেতা হয়ে গেছেন ।‘’ কাউকে তুমি বলা কাকা বাবুর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। রনো ভাই,রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফরদের মতো তরুণদের দেখে তিনি বাংলাদেশে বাম আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ আশাবাদী হয়েছিলেন।পশ্চিম বঙ্গে এদের সমবয়সী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,অনিল বিশ্বাস ও বিমান বসুরা তখনো ছাত্র নেতা। বয়স একই রকম হলেও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী এই নেতাদেরকে তারা রীতিমত সমীহ করতেন।
প্রসঙ্গত ঘটনাটি মনে পড়লো। আমার সেন্ট্রাল রোডের অফিসে রনো ভাইয়ের আসা যাওয়া ছিল। সেদিন শুরু থেকেই লক্ষ করলাম তার মন কিছুটা বিষন্ন । কথায় কথায় প্রকাশ পেলো , কোন এক উপলক্ষে রনোভাই ভারত যাচ্ছিলেন । কিন্ত ভারতীয় ইমিগ্রেশন তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে । সে দেশে তিনি অবাঞ্চিত ব্যক্তি । ফলে ভারতীয় বিমান বন্দর থেকে ফেরত এসেছেন । তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ,এ ও সম্ভব! যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিস্ট নেতাদের প্রবেশে আইনগত বিধি নিষেধ রয়েছে। কিন্ত সে দেশে প্রবেশেও তার সমস্যা হয়নি।
‘ যে ক’দিন বেঁচে আছি ,আমি আর ভারত মুখো হচ্ছি না।‘ বুদ্ধবাবু তখন মুখ্যমন্ত্রী, যদিও সুর্য পশ্চিমে হেলেছে, কিন্তু সিপিএম এবং বামফ্রন্ট তখনো পশ্চিম বঙ্গে অস্তমিত সুর্য নয় । আমি তাকে পরামর্শ দিলাম তার ক্ষমতাসীন বন্ধুদের সাহায্য নিতে। সে কথা কানে তোলা দূরে থাক,তিনি এমনকি তাদের কে এ কথা জানতে দিতেও নারাজ ।
রনো ভাইয়ের পরিচয়ের পরিধি শুধু রাজনীতিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।কাজেই চেনা জানা কবি,সাহিত্যিক,সাংবাদিক,চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্টকর্মী , অস্ত্র ব্যবসায়ী , জেলখাটা আসামি, শ্রমিক ,কৃষক ও ছাত্র কর্মীরাও তার গল্পে আবির্ভুত হতেন । রনো ভাইয়ের বিদেশ ভ্রমনের সম্বৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিল। এতোটাই যে, দেশে কি বিদেশে সে খবর নিশ্চিত হয়ে দেখা করতে যেতাম। দলের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দায়িত্ব বরাবরই ছিল তার কাঁধে। তাঁর উপস্থিতিতে এ দায়িত্ব অন্য কারো হাতে অর্পন করার কথা ভাবাই যেত না । ইংরেজী ভাষায় তার অনায়াস দখল ছিল, হিন্দি উর্দু বলতে পারতেন। মার্ক্সবাদি তত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঘোরপ্যাঁচ,বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল বিশেষজ্ঞ সুলভ। তিনি বিশ্ব সাহিত্য ও শিল্পের সমঝদার ছিলেন , ছিলেন দর্শন ও বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পাঠক। ফলে ভিন দেশী নেতৃবৃন্দের সাথে সহজ সম্পর্ক স্থাপন বা বিদেশের মাটিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে তার সমস্যা হতো না । গল্পের ঝোলাটি তিনি দেশে ফেলে রেখে যেতেন না , সর্বত্র বহন করতেন।
সুকুমার রায় লিখেছেন,‘আমরা সবাই রামগরুড়ের ছানা , হাসতে মোদের মানা’, বিশেষত বিপ্লবী নাম ধারণ করলে তো কথাই নেই । কিন্তু রনো ভাই ছিলেন উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। তাঁর ছিল অসাধারন রসবোধ , শব্দ চয়নের মুন্সিয়ানা ও পরিমিতি জ্ঞান। ঝুলি থেকে একটি একটি করে গল্প বের করে মশলা মাখিয়ে তা তিনি আসরে উপস্থাপন করতেন। অসুবিধের দিক হলো ,আপনি আড্ডায় এমনি মজে গেলেন যে জরুরী কাজের কথা মনে পড়লো না। বাসায় ফেরার পর গৃহিনী যখন বাজারের খোঁজ করলো,আপনি তখন দিশেহারা। আড্ডায় আসক্তির কারনে জীবনব্যাপী কম গঞ্জনা সইতে হয়নি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি পারি,আড্ডার মতো একটি বিষয়কে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার মতো যাদুকরী ক্ষমতা রনো ভাইয়ের অধিকারে ছিল।

 

তুমুল আড্ডাবাজ হলেও রনো ভাই ছিলেন চলনে ও বলনে একজন পরিশীলিত মানুষ ।পড়নের পাটভাঙা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী ও পায়জামার মতই নিষ্কলুষ ও পরিপাটি । তার সৌজন্য জ্ঞান ছিল নির্ভুল ও অসাধারন, ছিলেন বিশুদ্ধ নিখাদ ভদ্রলোক । এটি তার জন্য কোন আয়াস সাধ্য ব্যাপার ছিল না , ছিল সহজাত , কয়েক পুরুষের ধারাবাহিক শিক্ষা দীক্ষা , জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার সুফল, পারিবারিক উত্তরাধিকার । রনো ভাইদের বাড়ি থেকে কিছু না কিছু মুখে না দিয়ে ফিরেছেন,এমন একজনের ও সন্ধান মিলবেনা । দুঃখের বিষয় এই সুযোগের পুর্ন সদ্ব্যবহারের সুযোগ থেকে আমি দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলাম। কারণ তাঁর সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তুলনায় অন্য অনেকের চাইতে স্বল্পকালীন ।একেতো ভিন্ন দল করেছি ,তায় নাম গোত্রহীন কর্মী , তিনি তখন রীতিমত জাতীয় পর্যায়ের নেতা এবং দৈনিক পত্রিকা ও পোষ্টারের পরিচিত মুখ । রনো ভাইয়ের মুখ থেকে শোনা একটি গল্প পরিবেশন করছি ।
এ গল্পের মুল চরিত্র বামপন্থী আন্দোলনের পুর্ব প্রজন্মের এক মহীরূহ ব্যাক্তিত্ব,যিনি একই রকম রসিক ও আড্ডাবাজ ছিলেন । তাঁর নাম অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ। কুমিল্লা ভিক্টো্রিয়া কলেজের ইংরেজী সাহিত্যের এই অধ্যাপক ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণের কারনে চাকুরী হারান এবং জেল খাটেন । আইয়ুব খানের সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি এবং তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এই বিপ্লবী ভদ্রলোক জীবনের বড় সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে পলাতক জীবন যাপন করেছেন ।স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য জীবনে ফিরে আসার সুযোগ লাভের পর কোন একদিন তিনি রনো ভাইদের ধানমন্ডীর বাসায় আসেন । পরিবারের সবার সাথেই তাঁর জানাশোনা ছিল । অনেক গাল গল্পের পর উঠে যাওয়ার সময় তিনি মন্তব্য করলেন ,’’ রনো ,আজকের দিনের আলাপ-আলোচনাটা খুব ই ফলপ্রসূ ছিলো।এজন্য তোমার মাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।“
রনো ভাইয়ের চোখ কপালে । আসহাব উদ্দিন যোগ করলেন, “ তোমার মা খাওয়ার জন্য টেবিলে অনেক রকম সুস্বাদু উপভোগ্য ফল পরিবেশন করেছেন । অনেক দিন পর মন ভরে তাই খেলাম।আজকের দিনটা সত্যিকারের সুফলপ্রসূ ।“ বলেই বিদায় হলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন চট্টগ্রামের একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে যুক্তফ্রন্ট এর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা খাজা নাজিমুদ্দিন বাঁশখালীর উদ্দ্যেশে রওয়ানা হন। কিন্তু মাঝপথে প্রকৃ্তির ডাকে সাড়া দিতে তাকে ফের চট্টগ্রামে ফেরত যেতে হয় ।সেকালে বাঁশখালীর মত সুদূর গ্রামাঞ্চলে মলত্যাগের ব্যাবস্থা ছিল বাড়ি সন্নিহিত ঝোপ জংগল বা টাট্টিখানা, যা নওয়াবজাদাদের মর্যাদা ও অভ্যাসের সম্পুর্ন পরিপন্থী। বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য অনোন্যোপায় খাজা নাজিমুদ্দিন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ফেরৎ যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ঘটনাটি লোকমুখে ব্যাপক রটে যায় । শেষ নির্বাচনী সভায় অধ্যাপক সাহেব বক্তৃতায় বলেন ,” ভাই সব, আমাদের সমস্যা ‘খানা’ । মুসলিম লীগের শাসনে দুবেলা ভাত জুটানোই কঠিন । কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই। তাদের সব দুশ্চিন্তা ‘পায়খানা’ নিয়ে।‘’ বলাবাহুল্য , তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ হেন আসহাব উদ্দিন সাহেবরা যখন দল নেতা , আমরা তখন সে দলে নব দীক্ষিত কর্মী মাত্র। সৌভাগ্য বশত দলীয় বৈঠক ও কংগ্রেসে তার অনুনোকরণীয় বাচন ভঙ্গি ও সাহিত্যকর্মের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছিল। তিনি ছিলেন শব্দের যাদুকর। বাংলা সাহিত্যে অনুপ্রাস বা pun ব্যবহারে শিবরাম চক্রবর্তী ছাড়া তাঁর তুল্য দক্ষতা আর কারো নেই । দুর্ভাগ্যের বিষয় অধুনা একুশে পদক প্রাপ্ত এই বিপ্লবী সাহিত্যিক ও তাঁর সাহিত্য কর্ম বিস্মৃ্তির অতলে হারিয়ে গেছে।

মুল কথায় ফিরি। রনো ভাইদের গৃহে মা এর উপস্থিতি ছিলি সর্বব্যাপী,গার্হস্থ্য কর্মে ও অতিথি আপ্যায়নে তিনি ছিলেন কল্যাণময়ী দাত্রী। দুই সন্তান রনো ও জুনোর জীবনে তিনি ছিলেন মুল প্রেরণা । তদানীন্তন নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের দুই সন্তানই সার্বক্ষনিক বিপ্লবী কর্মীর অনিশ্চিত জীবন বেছে নেওয়ার দুঃসাহস বিরল । এ ব্যাপারে পরিবারের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল তাদের সহায় । উল্লেখ্য, রনো ভাইয়ের বাবা হাতেম আলী খান ছিলেন পুর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সরকারী বিনির্মান ও উন্নয়ন সংস্থা ‘সি এণ্ড বি’ এর প্রধান প্রকৌশলী। বৃটিস শাসিত পুর্ব বঙ্গে স্নাতক পর্যায়ের কোন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুপস্থিত ছিল। পিছিয়ে থাকা বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে প্রকৌশলীদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।যে ক’ জন ছিলেন শিক্ষিত সমাজে সবাই তাদের নাম জানতন ।
রনো ভাইয়ের মা প্রিয় দর্শিনী কানিজ ফাতেমা মোহসীনা, বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। নিঃসন্দেহে এটি সম্ভব হয়েছিল তাঁর বাবা সৈয়দ নওশের আলীর জন্য। এই আইনজীবী রাজনীতিবিদ জাতীয় কংগ্রেস দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি,বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য , অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রী সভার সদস্য ও বঙ্গীয় আইনসভার স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন । তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান আর্মিরও সদস্য ছিলেন । তেভাগা আন্দোলনের সময় তিনি জমিদার ও ভুস্বামীদের বিরুদ্ধে সাধারন কৃ্ষক জনতার পক্ষ নেন এবং এবং পরবর্তি কালে নিজের চুড়ান্ত রাজনৈতিক ঠিকানা হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেছে নেন।
নানা সম্পর্কে এই গল্পটি রনো ভাই আমার সাথে করেছেন ২০২১ সালে,ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাতে গেলে । এটি তিনি পেয়েছিলেন তার মার কাছ থেকে। সৈয়দ নওশের আলী সাহেব ১৯৪৬ এর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় কলকাতার একটি মুসলিম প্রধান মহল্লায় বাস করতেন । মুসলমানদের জন্য সম্পুর্ন নিরাপদ এই মহল্লায় হিন্দু প্রধান মহল্লা থেকে ভেগে আসা বহু পরিচিত আত্মীয় স্বজন ও চেনা মানুষজনকে তিনি নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন । কিন্তু একদিন রাত্রিবেলা বাড়িটি আক্রান্ত হয় । যারা তাঁর বাড়ি আক্রমন করেন তাদের রণধ্বনি ছিল “ আল্লাহু আকবর, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান “। দাঙ্গাবাজরা ছিল দলে ভারি এবং মারমুখো। দূর থেকে আত্মীয় স্বজনরা শ্লোগান শুনেই বুঝতে পারেন আক্রমনের লক্ষবস্ত নওশের আলী সাহেব। কারন তিনি ছিলেন বাংলার সর্বমহলে পরিচিত মুসলিম রাজনিতিকদের অন্যতম,যিনি ভারতের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করা ও বাংলার বিভাজন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। স্বজনরা তাকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেও তিনি সম্পুর্ন অসম্মত হন। মুসলমান জনতা তার বাড়ি ঘেরাও এবং মিছিলের নেতারা গৃহের দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে। তারা দাবী জানায় ,সৈয়দ নওশের আলী সাহেব কে পাকিস্তান গঠনের দাবীকে সমর্থন করে একটি লিখিত বিবৃতিতে সই করতে হবে । নইলে বাড়ি ঘেরাও থাকবে , তিনি ঘর থেকে বেরুতে পারবেন না , প্রাণেও রক্ষা পাবেন না । পাকিস্তান পন্থীদের সাথে তার তুমুল বিতণ্ডা হয় । কিন্তু তিনি অনমনীয় থাকেন । খবরটি আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লে মহল্লার দাঙ্গা বিরোধী যুবকরা দ্রুত সংগঠিত হয়ে একটি মিছিল নিয়ে তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে এবং দাঙ্গাকারীরা মহল্লা ত্যাগ করে।
নওগাঁয় জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ নওশের আলী সাহেব ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরই কেবলমাত্র মাতৃভুমিতে ফিরে আসেন ।১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল তিনি ৮০ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইতিহাসের এমনি বিচিত্র গতি, বাড়ি আক্রমনকারী পাকিস্তান পন্থীদের মিছিলে যে যুবক নেতৃ্ত্ব দিয়েছিলেন তিনি পরবর্তী কালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নাম ভূমিকায় আবির্ভুত হয়েছিলেন ।

মোজাম্মেল হক তারা বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ