২০ ডিসেম্বর -২৩

ফেনীর প্রখ্যাত কৃষক নেতা মরহুম সিরাজুল হক মজুমদার ঢল সাহেব এর ৩৬ তম মৃত্যু দিবসে এক আলোচনা সভা আগামী ৪ জানুয়ারি -২৪ বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেণীর ছাগলনাইয়া কলেজ রোডস্থ গনপাঠাগার অনুষ্ঠিত হবে। আপনারা আমন্ত্রিত।।


আলোচ্য সূচিঃ জিরাতিয়া প্রজা আন্দোলন। উক্ত সভাকে সফল করার জন্য ফেনী জেলা কৃষি উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মরহুমের শুভাকাঙ্খি ও মেহনতি কৃষক শ্রমিকদের বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।

সিরাজুল হক মজুমদার সংগ্রামী আদর্শের পথিকৃত

প্রচলিত অর্থ আদর্শ হলো একটি সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গী, যার সাহায্যে আমরা বিশ্ব প্রকৃতির যাবতীয় ঘটনাবলীকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব তথা জীবন প্রবাহকে অনুধাবন ও বিচার বিশ্লেষণ করি। আদর্শের ধারণা পরিষ্কার থাকার ফলে, যিনি সংগ্রামী মেহনতি মানুষের কাতারে এসে তাদের জন্য কাজ করার সংকল্প নিয়েছিলেন এবং আজীবন গরীব শ্রমজীবি মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন তিনি হলেন সিরাজুল হক মজুমদার। ঢল কোম্পানী হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। সংগ্রামী মানুষের দুশমন সাম্রাজ্যেবাদের এদেশীয় দোসরেরা অবহেলিত শোষিত মেহনতী মানুষদের শোষণ মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছিল। দালাল চক্র বুঝানোর চেষ্টা করেছিল যে, ‘আমাদের পূর্ব প্রজন্মের পাপের কার ণে আমরা দরিদ্র। আর পূর্ব প্রজন্মের পূণ্যের জন্য ধনীর সৃষ্টি হয়।’ ফলে জনগনের মধ্যে অদৃষ্টবাদীতা চরম আকার ধারণ করে। তারা বিশ্বাস করে, নসিবে যাহা আছে তাহা রদ হবার নয়। মরহুম সিরাজুল হক মজুমদার ছিলেন একজন ইহজাগতিক (সেক্যুলার) চিন্তার মানুষ। তিনি এ দর্শন বিশ্বাস করেন নাই। তাই তিনি মেহনতী মানুষের কাতারে এস তাদের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। গরীব মানুষের পক্ষে সমাজ বদল তথা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার এ দর্শনের জন্য তিনি তার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বদলানোর সংগ্রামে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষি সংকট বা কৃষকদের সমস্যাই আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের পথেই অগ্রসর হতে হবে। সেই লক্ষ্যে নিয়েই তিনি কৃষকদের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন্ তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভূমিহীন কৃষকদের জন্য জমি বরাদ্দ। বিনামূল্যে সার, বীজ, ঔষধ সরবরাহ। ভূমিহীনদের নিকট খাস জমি বন্টন, সমস্ত বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ। কৃষকদের উন্নতির জন্য কৃষি পণ্যের উচিত মূল্য নিশ্চিত করা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের ব্যবস্থা করা ছিল তার অন্যতম দাবী।
তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের জনগণই হবে দেশের সমগ্র সম্পদের মালিক। আর সম্পদের উপর নির্ভর করেই দেশের জনগণ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে সমৃদ্ধশালী সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে। জনসংখ্যাকে নিয়োগ করা হবে সম্পদ সৃষ্টির কাজে। দেশ হতে চিরতরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, খাদ্য ঘাটতি ও বেকারত্ব দূর হবে। কৃষি বিপ্লবকে জয়যুক্ত করার মধ্য দিয়ে জনতা ক্ষুধা হতে মুক্তি পাবে। তিনি সব সময় বলতেন আমাদের জাতীয় চরিত্র সংশোধন করতে হবে। তিনি বলতেন আমাদের বিত্তের দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এ দুই শ্রেণীর লোকেরা শাসক শ্রেণী হিসাবে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এদেরকে সহায়তা করে আমলারা। এর মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, স্বাস্থ্যনীতি কোনটিই স্বনির্ভর হয় নাই বরং পরনির্ভর হয়েছে।

মুক্ত বাজার অর্থনীতি দেশীয় শিল্পের বিকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। যা কয়েকটি শিল্প কলকারখানা আছে, তাও অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে উৎপাদন-অক্ষম। ফলে বিদেশী শিল্প-দ্রব্য আমদানীতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। পুঁজিবাদী সমাজে শিক্ষা হল আর দশটা ভোগ্য পণ্যের মত বাজারের পণ্য, যে যেমন দাম দিতে পারবে সে সেই মানের শিক্ষা কিনতে পারবে। অর্থাৎ টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতি চলছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধাক্কায় কৃষি উপকরণ দূর্মূল্য হয়ে পড়েছে। এক কেজি চাল বিক্রি করে কৃষক এক কেজি ইউরিয়া সার পাবে। দেড় কেজি চাল বিক্রি করে এক কেজি টিএসপি সার পাবে। এক কেজি চাল বিক্রি করে এক কেজি পটাশ সার পাবে। কীটনাশক ঔষধ ও কৃষি যন্ত্রপাতি এই ভাবে কৃষকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলত কৃষক উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আমাদের দেশে প্রতি বৎসর খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এর আনুষঙ্গ হিসাবে আমাদের দেশের লোক দিন দিন বেকার হচ্ছে। বিকল্প কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ নাই। এর ফলে কি শহরে কি গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্ম সন্ধানীদের সামনে কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই তারা বিপদগামী অথবা বিদেশগামী হচ্ছে।
বিগত সরকারগুলি সরকারী শিল্প কারখানা অলাভজনক দেখিয়ে বন্ধ করে বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার কারনে এদেশে শিল্প পুঁজির বিকাশ লাভ করেনি। স্বাধীনতার ৪০ বৎসরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে লক্ষলক্ষ। আর এ ধনপতিরা শিল্পে বিনিযোগ করতে আগ্রহী নয়। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ সময় সাপেক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা যে দিকে বেশী মুনাফা আসবে সেদিকে এরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ব্যাংক, বীমা, পরিবহন, নির্মাণ ও ঠিকাদারী ফার্ম, ট্রাভেল এজেন্সী, ইনডেন্টিং, আমদানী, রফতানী ব্যবসা, হোটেল ব্যবসা, উৎপাদনশীল খাতে ভূমিকা না থাকায় লুটপাট, দুর্নীতি, কমিশন ভোগী ও ঋণ খেলাপীদের কারণে দেশের অর্থনীতির এ সংকটাপন্ন অবস্থা হয়েছে। শতভাগ লাভের সম্ভাবনায় এরা বিকেক ন্যায়নীতিবোধ মানবিকতা সবকিছু জলাঞ্জলী দিতে প্রস্তুত। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা। যার কাছে টাকা আছে সে টাকার বিনিময় সেবা পাচ্ছে। আর গরিবেরা রোগের যন্ত্রনায় বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে অর্থাভাবে গরিব মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। সিরাজুল হক মজুমদার সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল বৈষম্য বিরাজমান ছিল তার বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকন্ঠ। তিনি বলতেন এখনও সময় আছে আমাদের চিত্তের দৈন্য স্বীকার করে নিজেদের চরিত্র সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে। আজীবন তিনি সমাজের সর্বস্তরের চিত্ত প্রসার ও বৈষম্য নিরসনে কাজ করে গেছেন।
আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন বিভিন্ন মিটিং এবং মিছিলে খদ্দরের পায়াজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত শশ্র“মন্ডিত অবস্থায় উনাকে দেখতাম। লোকে ডাকত ঢল কমিটি বা ঢল কোম্পানী বা ঢল সাহেব হিসাবে। আসল নাম জানতাম না, পরে যখন নবম বা দশম শ্রেণীতে উঠি তখন তাঁর নাম জানতে পারলাম সিরাজুল হক মজুমদার। তিনি ১৯৪০ সালে থেকে অত্র অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রনে ঢল কমিটি (বন্যাকে ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় ঢল বলা হয়) গঠন করেন। ফেনী জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ঢল কমিটি গঠন করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ফেনী মহকুমার বড় কর্মকর্তার মাধ্যমে ফেনী জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ পেশ করেন। সুপারিশের প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকারের ইরিগেশন মন্ত্রণালয় হতে একটি জরিপ টিম এসে ফেনী জেলার বন্যা জরিপ পরিচালনা করে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করেন।

এই সব পরিকল্পনার কিছু ছিল স্বল্পমেয়াদী আর কিছু দীর্ঘমেয়াদী। স্বপ্লমেয়াদী হল ফেনীর মুহুরী, সিলোনিয়া ও কালিদাস পাহালিয়া নদীগুলি ড্রেজিং করা যেমন- কালীদাস পাহালিয়া খাল, কুহুমা খাল, আমিরাবাদ খাল। কয়েকটি খাল কাটার জন্য সরকার টাকাও বরাদ্ধ প্রদান করে। মুহুরী, সিলনিয়া ও কালীদাস পাহালিয়া খাল গিয়ে ফেনী নদীতে পড়েছে। ফেনী নদীতে স্লুইস গেইট নির্মাণ ও নদীর পাড়ে উঁচু বাঁধ তৈরি করা এবং খাল গুলির মুখে ছোট গেইট নির্মাণ করা ছিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
আমি ১৯৭০ সালে এস.এস.সি পাশ করি। ১৯৭২ সালে যখন ছাগলনাইয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় সেই প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে জনাব সিরাজুল হক মজুমদার ছিলেন অন্যতম। কলেজ কমিটি তখন ওনাকে কলেজ অফিস দেখা শোনার দায়িত্ব দেয়। আমি প্রথম ব্যাচের ছাত্র হওয়াতে উনার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। কারণ আমার বাবা মাষ্টার গোলাম মোস্তফাও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। যখন থেকে রাজনৈতিক পরিচয় হয় তখন আমি ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। সেই সময় তিনি ফেনী মহকুমা ন্যাপের সভাপতি ও নোয়াখালী জেলা কৃষক সমিতির সেক্রেটারী ছিলেন। সেই থেকে আমি উনার রাজনৈতিক শিষ্য, যা উনার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
সিরাজুল হক মজুমদার ছাগলনাইয়া থানার রাধানগর ইউনিয়নের উত্তর কুহুমা গ্রামে সম্ভ্রান্ত মজুমদার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০১ সালে সেই ছোট বেলায় প্রথমে ভর্তি হন করৈয়া সার্কেল স্কুলে। সেখান থেকে পাশ করে চট্টগ্রামের মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে স্কুলে ধর্মঘট হয়। কংগ্রেস এ আন্দোলনে সমর্থন দান করে। কিছুদিন আন্দোলন চলার পর তা স্তিমিত হয়ে গেলে তিনি সেখান থেকে এসে ফেনী পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হন। ফেনীতে কিছুদিন লেখাপড়া করে ছাগলনাইয়া হাই স্কুলে বদলী হয়ে যান, এখানেও কিছুদিন লেখাপড়া করার পর স্থানান্তরিত হয়ে জোরারগঞ্জ হাই স্কুলে ভর্তি হন। এরপর চট্টগ্রাম থেকে মেট্টিক পরীক্ষায় পাশ করেন।
তিনি ছাত্রাবস্থায় কংগ্রেসের বৃটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে যোগদান করেন। তখন তিনি মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর ১৯২৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যে লবন আন্দোলন হয় সে আন্দোলনেও তিনি যোগদান করেন। এছাড়া তিনি জোরারগঞ্জ হাই স্কুলে পড়ার সময় ইতিহাসখ্যাত বিপ্লবী মাষ্টারদা সুর্য্যসেনের নেতৃত্বে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। কয়েকজন বন্ধু তাকে সূর্য্যসেনের নিকট নিয়ে যান। সূর্য্যসেন তার সাথে কথা বলে আনন্দিত হন এবং তাকে কাজ করে যেতে পরামর্শ দেন। তিনিও তার কয়েকজন বন্ধু এসময় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এরপর তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। বিদেশী বা বিলাতি পণ্য বর্জন করতে লোকদের উদ্বুদ্ধ করেন। তখন ফুরফুরা শরীফের মাওনালা আবু বকর (রঃ) সাহেব উত্তর কুহুমা গ্রামে এসে এক ওয়াজ মাহফিলে প্রত্যেককে দেশী খদ্দরের কাপড় পরার জন্য ওয়াদা করান। সিরাজুল হক মজুমদারও মাওলানার নিকট ওয়াদা করেন ও আমৃত্যু সেই ওয়াদা পালন করেন। সিরাজুল হক মজুমদার সাহেবের মুত্যুর পর উনার কাপন দাফনও খদ্দর কাপড় দিয়া সম্পন্ন হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ৫৪ সালে প্রদেশে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। আবুল হোসেন ও আতাউর রহমান খানের সময় উক্ত সময়কালে বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য মুহুরী নদী ও সিলোনিয়া নদীর কিছু টেক/বাঁক সোজা করা হয়েছিল এবং ফুলগাজীতে মুহুরী নদীর পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। কালিদাস পাহালিয়া খাল খনন করা হয়। এ খাল খনন করার ফলে বন্যার তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং কালিদাস/পাহালিয়া অঞ্চলে জলাবদ্ধতার অবসান ঘটে। এই বন্যা নিয়ন্ত্রণের আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি পরিবারের প্রতি না তাকিয়ে তার সমস্ত স্থাবর সম্পদ বিক্রি করেছেন। জনগণের প্রতি অপরিসীম দরদ তাকে অমরত্ব দেয়। তাঁর এরূপ অবদানের জন্য অন্দোলনের নামেই ওনার নাম হয়ে যায় ঢল কমিটি বা ঢল সাহেব। ওনার নামের সাথে আর একজন নেতার নাম এসে যায়, তিনি হলেন ফেনীর কুঠির হাটের রফিক উদ্দিন আহাম্মদ ইন্তু মিয়া। এ নামে লোকে তাঁকে চিনত না, লোকে চিনতো গরীবের বন্ধু ইন্তু মিয়া বলে। সেই সব নেতাদের সাথে বর্তমান নেতাদের কীভাবে তুলনা করা যায়! এখনকার নেতারা গরীব মানুষদের রাজনীতি-ব্যবসার হাতিয়ার বানিয়েছে। এরা নির্বাচিত হলে প্রথমে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কথা চিন্তা করে। তারপর পর্যায়ক্রমে আসে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি ইত্যাদি। জনগনের কথা এরা কাদাচিৎ ভাবে।
১৯৪৯ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে সিরাজুল হক মজুমদার ও আবদুল জব্বার খদ্দর আওয়ামী মুসলিমলীগে যোগদান করেন। তখন ফেনীর খাজা আহম্মদ তাঁকে গণতান্ত্রিক দলে যোগদানের অনুরোধ করেছিলেন। টাঙ্গাইলের কাগমারিতে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সম্মেলনেও সিরাজুল হক মজুমদার নোয়াখালী জেলা থেকে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় স্যার রেডক্লিপের নেতৃত্বে বাউন্ডারী কমিশন, ফেনী ও ত্রিপুরা সীমান্ত তড়িাঘড়ি করে এলোপাথাড়িভাবে চি‎িহ্নত করে বসেন। এতে আন্তর্জাতিক সীমারেখার কোন নিয়ম মানা হয় নি, শুধু জরিপ ম্যাপের ভিত্তিতে সীমারেখা চি‎িহ্নত করা হয়। ফলে দেখা যায় সীমান্ত এলাকার বসবাসকারী লোকজনের ঘর বাড়ি পড়েছে ফেনীতে আর জমি পড়েছে ত্রিপুরা রাজ্যে। এমনকি কমিশনের সীমারেখা বাড়ীর মধ্য দিয়ে পড়েছে। ফলে এক বাড়ির লোক দুই দেশের নাগরিক হয়ে গেছে। এর ফলে সীমান্ত এলাকার হাজার হাজার লোক জায়গা জমি আবাদ করতে বা হস্তান্তর করতে ভীষন অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ফেনীর ত্রিপুরা সীমান্তে এ সমস্যা কে জিরাতিয়া সমস্যা বলা হয়। স্থানীয় এ সমস্যা সমাধানের জন্য এক গনআন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান ফেনী সফরে এলে ফেনী হাই স্কুল মাঠে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। তাকে প্রদত্ত মানপত্রে ফেনী এলাকার বন্যা সমস্যার ও জিরাতিয়া সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয় এবং এ সমস্যা সমাধানের জন্য দাবী উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সরকারী ভাবে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা না নেয়ায় সিরাজুল হক মজুমদার স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও জননেতাদের নেতৃত্বে এক আন্দোলন গড়ে তুলেন। এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা হলেন ফেনীর আইনজীবি ওবায়েদ উল্যাহ রৌশনাবাদী (ছাগলনাইয়া), পূর্ব দেবপুরের মজিবুল হক মজুমদার, পরশুরামের সামছুল হুদা মজুমদার, চাঁদগাজীর আবু বক্কর ছিদ্দিক, জয়পুরের সুলতান আহম্মদ চৌধুরী, পরশুরামের লাতুমিয়া, ফুলগাজীর ছাদেক আহম্মদ প্রমুখ। অত্র অঞ্চলের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ফেনীর বন্যা সমস্যা ও জিরাতিয়া সমস্যা সমাধানের জন্য উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছিলেন।
১৯৫৭ সালে জুলাই মাসে ঢাকার রুপমহল সিনেমা হলে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন হয় তখন থেকেই সিরাজুল হক মজুমদার বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ন্যাপের সম্পাদক, ফেনী মহকুমা ন্যাপের সভাপতি ও কৃষক সমিতির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তৎকালীন সময় নোয়াখালী ও ফেনী মহকুমার যারা নেতৃত্ব ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, নোয়াখালী সদরের খালেদ সাইফুল্লা, নুরুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ তোহা, আরিফুল রহমান সুধারামী, ফেনীর আব্দুল অদুদ, ডাঃ তফাজ্জল হোসেন, সিরাজুল হক মজুমদার, জিয়াউল হক।
১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় ক্ষমতাসিন মুসলিমলীগ ছাড়া সম্মিলিত বিরোধীদল মিলে ঈঙচ (ঈড়সনরহবফ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ ঢ়ধৎঃরবং) গঠন করল। মুসলিম লীগের প্রার্থী হল পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আর ঈঙচ এর প্রার্থী হল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন ফাতেমা জিন্নাহ। ছাগলনাইয়া থানাতে ঢাকা সিটি ন্যাপের সভাপতি আবদুল জলিল ও সিরাজুল হক মজুমদারর নেতৃত্বে ঈঙচ এর পক্ষে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ভোটার ছিল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররা। ছাগলনাইয়াতে ফাতেমা জিন্নাহ পেয়েছিলেন ১৪৪ ভোট, আইয়ুব খান ৪১ ভোট পেয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গঠন করে জাগদল। এর পর জাগদল, ভাসানী ন্যাপ, তফসিলি ফেডারেশন, লেবার পাটি নিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। তখন তিনি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ফেনী জেলা আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। জাতীয় ফ্রন্ট একত্রিত হয়ে জাতীয়তাবাদী দল ঘটিত হয়। তখন জাতীয় পারিষদের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। মসিউর রহমান যাদু মিয়া ও এস.এ বারি এ.টি উনার জন্য মনোনয়নের চেষ্টা করেও জাতীয়তাবাদী দল থেকে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি জাতীয়তাবাদী দল ত্যাগ করে কৃষক সংগ্রাম সমিতিতে যোগ দান করে কেন্দ্রীয় সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। মুহুরী প্রজেক্টের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও সেচ কর বন্ধের আন্দোলন মজুমদার সাহেবের অন্যতম অর্জন। সিরাজুল হক মজুমদার ১৯৭৩ সালে রাধানগর ইউনিয়নে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
সিরাজুল হক মজুমদারের ইচ্ছা ছিল জীবনে একবার হজ্জ্ব করবেন কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। এছাড়া তিনি সংসদে মেহনতী জনগণের পক্ষে কথা বলতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি দলীয় মনোনয়ন পান নাই। মজুমদার সাহেব জীবনের শুরুতে নিপিড়িত, নির্যাতিতদের জন্য যে সংকল্প ও উদ্যম নিয়া কাজ করেছেন আমৃত্য তা অব্যাহত ছিল। তিনি দেশকে ভালবাসতেন, দেশের মানুষকে ভালবাসতেন। কোন খাদ ছিলনা তার ভালবাসায়। নিজের ও পরিবারের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে মানুষের চিন্তাই করে গেছেন আজীবন।
বিশিষ্ট সমাজ কর্মী সিরাজুল হক মজুমদার সাহেবের প্রচেষ্টায় সরকার থেকে ছাগলনাইয়া কলেজের বিজ্ঞান ভবনের টাকা বরাদ্দ হয় ও তৎকালীন সিনিয়র মন্ত্রী মসিউর রহমান জাদু মিয়া বিজ্ঞান ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য সদা সচেষ্ট ছিলেন। ছাগলনাইয়া কলেজ প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি একজন। এই কলেজের উন্নয়নে তার অবদান অবিস্বরনীয়। ১৯৮৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী আজীবন সংগ্রামী এই নেতা ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। তাঁর মত আজীবন ত্যাগী নেতার প্রয়োজন আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে। তিনি প্রকৃত অর্থেই সংগ্রামী আদর্শের পথিকৃত।

লেখক: আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক, গণ পাঠাগার, ছাগলনাইয়া, ফেনী।

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ