এডভোকেট খোরশেদ আলম খোন্দকার, লেখক

১১ ডিসেম্বর ২৩ খ্রিঃ- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এ দেশের মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। সারা জীবন তিনি আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। সুখ-শান্তি লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে তিনি অকাতরে নিজকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের জন্য। তিনি চেয়েছিলেন এ দেশে একটি সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ – আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক। স্বাধীনতার ছেঁচল্লিশ বছর পরও তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের চিন্তা চেতনায় পৃথিবী অনেক এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু আমাদের দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। আমরা গত শতাব্দিতে দু-দু’বার স্বাধীনতা পেয়েছি। একটি ভৌগলিক সীমানা এবং একটি পতাকা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা পাইনি। স্বাধীনতার ছেঁচল্লিশ বছর পরও আমরা ঠিক করতে পারিনি এ দেশের সরকার নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কারো উপর আস্থা রাখতে পারছেনা। সর্বত্রই যেন অবিশ্বাস সারা জাতিকে হতাশ করে ফেলছে। সর্বত্রই যেন, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, পেশি শক্তির প্রভাব সমগ্র জাতিকে গিলে ফেলছে।আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে আবারো জিম্মি জনগণ। নিজেদের লুটপাটের প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ সংঘাতে তারা জনগণ ও সংবিধানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এদের কথায় মনে হয় যেন সংবিধানে শুধুমাত্র ভোটের কথাই বলা আছে। শাসক শ্রেণি প্রণিত এ সংবিধানের অনেক সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও জনগণের যতটুকু অধিকারের কথা আছে তাকে পদদলিত করে দেশ পরিচালনার কারণে স্বাধীনতার পর ৪৬ বছরে আমরা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসনে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুৎ, সারের দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি, গাড়ী ভাড়া-বাড়ী ভাড়া বৃদ্ধি, ঘুষ দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, বিদ্যুৎ সংকট, ক্রসফায়ার-গুম, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ছোট মাঝারী কৃষকের আহাজারি, ভবনে ধ্বংসে-অগ্নিকান্ডে শ্রমিকদের মৃত্যু, মুজুরীসহ অধিকার দাবীতে আন্দোলনরত গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর পুলিসি নির্যাতন, নারী নির্যাতন, মাদকাসক্তি-মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি জনজীবন অতিষ্ট করে তুলছে। অচল অবস্থার কারণ যে আমরা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদী শোষণ শাসন তাকে আডাল করার জন্য বুর্জোয়াদের দালাল জোট সমূহ সহ এ দেশে তথাকথিত সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদী কতেক বাম রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকটকে সামনে এনে শ্রেণি চেতনার ভিত্তিতে আন্দোলন সংগ্রামকে পরিচালিত না করে জনগণকে বারবার বিভ্রান্ত করছে। ক্ষমতা কেন্দ্রিক কোন্দলে সুবিধা পেতে জোট-মহাজোট এবং তাদের দালালরা মার্কিন ভারতসহ সম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর আশির্বাদ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় দেশের সার্বভোমত্ব ও মর্যাদা ভূলণ্ঠিত করে নগ্নভাবে দালালী করছে।
প্রায় ২০০ বছর আমরা ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম। আর দুই যুগ আমাদের শাসন করেছে পাকিস্তানিরা। ঔপনিবেশিক শাসকদের চেষ্টাই থাকে দখলকৃত দেশের জনগণের মধ্যে যাতে স্বাধীনতার চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, কেবল উগ্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা শুধু দমনই করেনা, কৌশলে পদানত জাতিকে চিন্তায়, মননে, সাংস্কৃতিতে পঙ্গু করে রাখতে চায়। এক মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা গোটা বাঙ্গালি জাতিকে বিশ্বাসঘাতক বানাতে পারেনা। কারণ, তারপর থেকে ২০০ বছরের বাঙ্গালির ইতিহাস ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস। বাঙ্গালিরা বারভূঁঞা, তিতুমীর, হাজিশরীয়তুল্লাদের বংশধর; ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদারদের উত্তরার্ধিকার। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাঙ্গালি জাতির আত্মদান ছিল সবার ওপরে। দ্বিজাতি তত্ত্বের মায়াবী স্বপ্নে বিভোর করে এ অঞ্চলের মানুষকে বেশীদিন অন্ধকারে রাখা যায়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বাঙ্গালিরা অধিকার রক্ষায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। রক্ত দিয়ে সৃষ্টি করে ভাষা আন্দোলনের অমর ইতিহাস, যা অনেক জাতিরই নেই। ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের অকল্পনীয় বিজয় পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আগাম সংকেত দিয়েছিল স্বাধীকারের। শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম, ’৬৯’র ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান এ যাবতকালের মুক্তিকামী মানুষের ইতিহাসে লেখা এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কোন রকম অনুভূতি ছাড়াই বলা যেতে পারে, বাঙ্গালি বীরের জাতি। বর্তমানেও জাতিসংঘ শান্তিমিশনে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখার কারণে বাঙ্গালিরা সারাবিশ্বে বিশেষভাবে প্রশংসিত।
এদেশের মানুষ ইতিহাস রচনা করেছে নিজেদের জীবন সংগ্রামেও। গত চার দশকে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অব্যাহত ভাবে এগিয়ে গিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মত ঘটনা ঘটিয়েছে। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখন্ডে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস-এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এই মানুষই বিশ্বমন্ধা উপেক্ষা করে খাদ্যশস্য উৎপাদন, তৈরী পোশাক খাত আর প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করেছে অব্যাহত গতিতে। আরপরও ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, বন্যা, খরার মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ এখানকার নিত্যসঙ্গী।এসব কারণে দূর্ভোগ বাড়ে, প্রতিবছর মারা যায় মানুষ, বিধ্বস্ত হয় তীর-উপকূল, লন্ডভন্ড হয় অসংখ্য জীবন। বিদেশীরা মনে করে, এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। বুঝি কোনদিনও আর জীবন ফিরে আসবে না এখানে। অথচ অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব তাকিয়ে দেখে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে এখানে কেমন করে জীবন আবার জেগে ওঠে, পল্লবিত হয় পত্র-পুস্পে শোষভিত হয় নিত্য-নতুনভাবে। এই সংগ্রামের ফসল মানুষ ঘরে তুলতে পারে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে। যুগযুগ ধরে বঞ্চিত-দুর্দশাগ্রাস্থ জীবনের অবসানের লক্ষ্যে এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সংগামের ইতহাসও বেশ দীর্ঘ।
পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শুরু হওয়া স্বাধীনতা আন্দোলনে মানুষ চেয়েছিল আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসন করে সমঅধিকার; বঞ্চনার অবসান অর্থাৎ উন্নত জীবন; মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র; ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদের বিলুপ্তি এবং দেশ গড়ার প্রেরণায় একীভূত হওয়ার অদম্য চেষ্টা, জাতীয়তাবোধ। এক কথায় স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক কল্যাণমুখী আধুনিক রাষ্ট্র গঠন। দুঃখের বিষয় এসব লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি।
স্বাধীন দেশের শুরুতেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শীতা, সীমাবদ্ধতা এবং দলীয় সংকীর্ণতা সমগ্র জাতির কাছে স্বাধীনতার চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ফলে জাতি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পেয়েছে, রাষ্ট্রনায়ক পায়নি। ব্যক্তি ও দলতন্ত্রের দাপটে জনগণের স্বপ্নই শুধু বিভ্রান্ত হয়নি, সমগ্র জাতির মধ্যে বিভক্তির বীজ এমনভাবে রোপিত হয়েছে যার নেতিবাচক পরিণতি এখনও জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে মানুষকে। মওলানা ভাসানী মজলুম জনতার পক্ষে থেকে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। কখনো কনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেননি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন সহ অবিভক্ত ভারতের অনেক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালে ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী শরাফত আলী খান। মক্তব হতে শিক্ষা গ্রহণ কিছুদিন মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ইসলাম শিক্ষার উদ্দেশ্য ১৯০৭ সালে দেহবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিওে আসেন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে দেশ বন্দু চিত্ররঞ্জনের স্বরাজ পাটি গঠন করে প্রথম কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরা খোলায় ও ১৯৩৩ সালে গায়বান্ধায় বিশ্ব কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭ সালে মওলানা ভাষানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলার সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মওলানা ভাসানী আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিন হন। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ গঠন করেন এবং তিনি সভাপতি নির্বাচিন হন। পাকিস্তান স্বৈরশ্বাসকের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন । মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেওয়ার উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ৮ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লি ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। অন্যায়ের সাথে চির আপসহীন এই মহান নেতা ১৯৭৬ সালে ঢাকায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মেহনতী মানুষ অনন্তকাল শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করবে এই মানুষটিকে। তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে। এ উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যার কোন উন্নত মানের বাড়ীঘর ছিলোনা। কোন দুর্নীতির সাতে যুক্ত ছিলেন না। মানুষের অধিকার আদায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ৩২ বৎসর জেল খেটেছেন কিন্তু দুর্নীতি করে অথবা ব্যক্তি স্বার্থে ১দিনও জেলা খাটতে হয় নি। মওলানা ভাসানী মজলুম নেতা হিসাবে একটি ইতিহাস। যাঁকে সামনে রেখে আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়ে যাবে। তিনি এ দেশের মেহনতী মানুষের অধিকার আদায় এবং গণতান্ত্রিক সমাজ বিনিমানের বাতিঘর হিসাবে দেশ জাতীর সমানে সারা জীবন অমর হয়ে থাকবেন। প্রেরণা যোগাবেন যুগ যুগ। ১৪৪তম জন্ম দিবসে শুভ কামনা।

লিখক একজন আইনজীবী ও সমাজকর্মী ।

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ