‘স্বাধীনতার চেতনা’ কিংবা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ আজকাল রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল উচ্চারিত শব্দ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বৃদ্ধ হয়ে এটা করতে হবে কিংবা ওটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী। তদুপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে বিভিন্ন সংগঠনও তৎপর। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের হস্তিদর্শনের মতই এটি একটি মনগড়া বিষয় হিসেবে পরিগণিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিশ্চয়ই কোন মনগড়া বিষয় নয়, এর একটি বাস্তব ভিত্তি আছে। এটি নিছক কোন শ্লোগান নয়, কিংবা নয় কোন কথার কথা। এটি একটি আদর্শগত বিষয় যা দীর্ঘ লড়াই ও অব্যাহত অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। মুক্তি অর্থ শোষণ থেকে নিপীড়ন থেকে মুক্তি, শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির যে লড়াই সেটাই হল মুক্তিযুদ্ধ, আর যে চেতনা এই মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করতে শক্তি সাহস যোগায় সেটাই হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখন প্রশ্ন হল শোষণ এবং নিপীড়নের জন্য দায়ী কে? শোষণ এবং জাতিগত নিপীড়নের জন্য দায়ী হল সাম্রাজ্যবাদ। অতএব, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধই হল মুক্তিযুদ্ধ। আর এ যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি হল সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি তথা জনগণের শক্তি।

সাম্রাজ্যবাদ তার শোষণকে অব্যাহত রাখে দেশীয় মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের দ্বারা অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ হাত হলে, মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া হাতিয়ার। সুতরাং ঐ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের চালিত লাগাতর সংগ্রাম হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী সংগ্রাম চালনার জন্য যে চেতনার প্রয়োজন, তাকেই বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অতএব, এক কথায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় লালিত হয়ে যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে। আর এজন্য প্রয়োজন শ্রেণী চেতনায় সমৃদ্ধ জনগণের শক্তি, যে শক্তির কোন বিকল্প নেই।

কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হচ্ছে সেটা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী জনগণের মুক্তির চেতনা নয়। বরঞ্চ স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে বিকৃত বিভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়া হচ্ছে।

আজকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথ বলেন, যাঁরা স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন, তাঁদের কথার ভেতর দিয়ে একটি কথাই বেরিয়ে আসে, আর তা হলো পাকিস্তান বিরোধীতার নামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থাৎ একমাত্র দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধীতাই হলো স্বাধীনতার চেতনা, যে চেতনা ‘৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির, যে চেতনার জন্ম ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রি থেকে, আর এর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত যে চেতনার বিদ্যমান ছিল তা হল অখন্ড পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্ত্বশাসন এবং যে শ্রেণী পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারাই বাংলাদেশে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে। ফারাক শুধু সময়ের। সুতরাং পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় মূলতঃ কোন ফারাক নেই।

এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনার অর্থ অধুনা উচ্চারিত স্বাধীনতার চেতনা নামক শ্লোগান থেকে ভিন্ন। ভিন্নতার অর্থ হল খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা তথা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। মুক্তির আকাঙ্খায় আশান্বিত মানুষ লড়াই করেছে, সশস্ত্র লড়াই করেছে। সে আন্দোলন, সে সমস্ত সংগ্রাম দেশব্যাপী সংগঠিত রূপ না পেতে পারে অথবা বিচ্ছিন্ন কিংবা স্থানিক হতে পারে, কিন্তু তার মূল সুর ছিল শোষণ থেকে, অত্যাচার থেকে, অধিক বৈষম্য থেকে মুক্তি। এই মুক্তি সংগ্রামের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, সংগ্রামী ঐতিহ্য আছে। আর তাই এদেশের মানুষ লড়াই এর ডাক শুনে বসে থাকতে পারেনি, যখনই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, যখনই তারা মাতৃভূমির ডাক দিয়েছে তখনই এই ব-দ্বীপের মানুষ সশন্ত্র হয়েছে স্বাধীনতার মন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। এই অঞ্চলের মানুষের এই সংগ্রামী মেজাজকে মুক্তির আকাঙ্খাকে সাম্প্রদায়িক শক্তি উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি, নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বার বার তারা প্রতারিত হয়েছে, আর বিভ্রান্ত হয়েছে তার মুক্তির চেতনা।

বৃটিশ-পূর্ব ভারতে এদেশের মানুষ লড়াই করেছে, বৃটিশ ভারতে এদেশের কৃষক-শ্রমিক মুক্তির জন্য লড়াই করেছে, কৈবর্ত বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যানী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত যা আজও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অম্লান। এদেশের কৃষকের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের রয়েছে বিস্তৃত পটভূমি যা গড়ে উঠেছে শত শত বৎসরের রক্ত-ঘাম আর শ্রমের সমন্বয়ে। খেটে খাওয়া কৃষক বারবার সংগ্রামের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছে, রক্ত রঞ্জিত করেছে বুকের তাজা রক্তে, এতদ্বাঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ বার বার পরীক্ষার ভেতর দিয়ে তার শ্রেণী চেতনাকে আরও বেশী বেশী করে শাণিত করে তুলেছে। কিন্তু সেই সংগ্রামী চেতনাকে বার বারই বিভ্রান্ত করা হয়েছে বিভিন্ন চটকদার বুলির দ্বারা।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট দালাল জমিদারদের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ এবং নির্যাতনে জর্জরিত এদেশের কৃষক যখন জমিদারদের বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, লড়াই করছে শোষনের অবসানের জন্য, ঠিক তখনই কৃষকদের এই সংগ্রামকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ভেদবুদ্ধি আমদানী করা হল, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সৃষ্টির আওয়াজ তোলা হলো, মুক্তির চেতনাকে বিকৃত এবং বিভ্রান্ত করবার জন্য কৃষকের শোষণের জন্য জমিদারকে দায়ী না বলে বলা হল মুসলিম শোষণের জন্য হিন্দুরা দায়ী। সেই সাথে মুক্তির যে চেতনা তাকেও মোড় নেওয়ানো হলো ভিন্ন দিক।

শ্রেণী চেতনাকে আড়াল করে প্রধান করে দেখানো হলো সাম্প্রদায়িকতাকে। আর সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে আনা হল তখন, যখন এদেশের কৃষক শ্রেণীসংগ্রামে উজ্জীবিত জমিদারদের বিরুদ্ধে তথা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এ নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন, যে মূহুর্তে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী লড়াই জঙ্গীরূপ ধারণ করেছে ঠিক সেই মূহুর্তে। কৃষক এবং জমিদারের শ্রেণীগত বিভাজনকে আড়াল করার জন্য শ্লোগান তোলা হল- হিন্দুরা শোষণ করছে মুসলমানদের। জনগণের মুক্তির ভেতরে ফাটল ধরানো হল। মুক্তির চেতনাকে বিভ্রান্ত করা হল। বলা হলা মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাই। যে মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করতে না পারলে যে শোষণমুক্তি সম্ভব নয় সেটাই প্রমাণ হল পাকিস্তান সৃষ্টির পর। পাকিস্তানের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ, তারা শোষণ থেকে মুক্তি পায়নি, নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় নাই। তাই লাখো কণ্ঠে শ্লোগান উঠল-“ লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়”। আর অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি শ্লোগান তুলল, এসব ইসলামের দুশমন পাকিস্তানের শত্রুদের কাজ। আর এই সাথে শোষক শ্রেণীর শোষণের তীব্রতা, অত্যাচারের মাত্র বেড়েই চলল, অন্যদিকে সংগ্রামী জনতাও তাদের মুক্তির আকাঙ্খায় আন্দোলন-সংগ্রামের পথে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হতে লাগল। পূর্ব বাংলার কৃষক বুকের রক্তে আন্দোলনের নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করতে লাগলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা, টংক, হাজং, নানকার বিদ্রোহ একে একে সারা পূর্ববাংলা ছড়িয়ে পড়লো। কায়েমী স্বার্থবাদী নব্য জমিদারদের গোলায় ধরাল আগুন, রাষ্ট্রযন্ত্রে আঘাত হানল, আর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, তাদের শোষণকে আড়াল করার জন্য, শাসনকে জায়েজ করার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল-এটি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কিন্তু সংগ্রামী জনতাকে ধর্মের শ্লোগানে বিভ্রান্ত করতে না পেরে সাম্রাজ্যবাদ নতুন খেলায় মেতে উঠল, চক্রান্তের নতুন জাল মেলে ধরল। সেটা উগ্র জাতীয়তাবাদের শ্লোগান। অর্থাৎ বলা হলো পাকিস্তানী শোষণের কারণেই বাঙালীদের দুর্দশা। এবারও শ্রেণী শোষণকে আড়াল করবার সাম্রাজ্যবাদকে আড়াল করবার অপপ্রয়াস চলল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে দায়ী না করে বলা হল পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে। আর একথা প্রচার করা সহজ হল এজন্যেই যে পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিরা অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী; অন্যদিকে এদেশের কৃষকের উৎপাদিত প্রধান পণ্য পাটের জন্য যে শিল্প কলকারখান গড়ে উঠেছিল তারও মালিক ছিল অবাঙালী, শুধু শিল্প কলকারখান নয়, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সেনাবাহিনী সর্বত্রই পাঠান-পাঞ্জাবী-সিন্ধীদের আধিপত্য; এবারও বোঝানো সহজ হল – তোমার শোষণ-বঞ্চণার জন্য দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানীরা, অতএব পাকিস্তান হটাও, সুখ সমৃদ্ধি তোমার ঘরে বয়ে আসবে। আবারও শ্রেণী শোষণের মুল যে বিষয় অর্থনৈতিক শোষণ আর এ জন্য যে দায়ী সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি তাকে আড়াল করা হোল। মুল শত্রু থেকে গেল অন্তরালে, সংগ্রামের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া হল।

শত শত বৎসর ধরে এই অঞ্চলের মানুষ সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সংগ্রাম করে আসছে মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য কায়েমী স্বার্থবাদীরা বরা বারই তাকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করেছে। আর এভাবেই রক্ত আর ঘামে গড়া সংগ্রামকে দিকভ্রান্ত করা হয়েছে সস্তা শ্লোগান তুলে সাম্প্রাদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে।

অহরহ ‘স্বাধীনতার চেতনা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে যা প্রচার করা হচ্ছে তা মূলত একাত্তরের যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই বলা হচ্ছে; আর এর রাজনৈতিক পটভূমি হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে ‘৫২ ভাষা আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলন এর সাথে অর্থনৈতিক আন্দোলনের কোন সংশ্রব ছিল না। আর ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন ছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ভাগাভাগির জন্য দরকষাকষির একটি উপায়মাত্র। এর সাথে সাধারণ শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিকের কোন স্বার্থ সংরক্ষিত ছিল না। সুতরাং ‘৫২’ ভাষা আন্দোলন কিংবা ‘৬৬’ ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটবার কোন সুযোগ আছে বলে ধারণা করাবার কোন অবকাশ নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক যে বিষয়টি এখন প্রচার করা হচ্ছে তার সাথেও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন সামঞ্জস্য নেই।

প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ অর্থই হল কৃষক-শ্রমিকের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তি তথা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। যেহেতু এদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রাম বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, সুতরাং মুক্তি অর্থই হল ঐ সাধারণ মানুষের মুক্তি। কিন্তু সেই মুক্তি তো আসেনি। কৃষক তার জমিতে অধিকার পেল না, শ্রমিক তার কলে-কারখানায় কোন অধিকার পেল না। বিপরীতে কি পেল? বিপরীতে পেল, আরও বেশী বেশী করে শোষণ, নির্যাতন, পেল সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত আন্তর্জাতিক পুঁজি সংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর ফর্মুলায় মিল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, অধিকতর বেকারত্ব, শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি, সার-বীজ-কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের নামমাত্র মূল্য অন্যদিকে ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি।

কিন্তু সেই প্রকৃত মুক্তির সুযোগ যে আসেনি তা নয়। দীর্ঘ লড়াই এবং সংগ্রামের মাঝ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা গড়ে উঠেছিল সেটিই ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে একটি পরিণতি লাভ করে। কৃষক-শ্রমিক-জনতার ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে পাকিস্তানের সেনা শাসক আইয়ুব খান তার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে-বন্দরে-ক্ষেতে-খামারে সর্বত্রই আওয়াজ ওঠে- ক্ষেতে কিষাণ, কলে মজুর জোট বাঁধ, তেরি হও, আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র, ভোটের আগে ভাত চাই, ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ কায়েম কর; পার্লামেন্ট না রাজপথ, গোলটেবিল না রাজপথ। জনতা রাজপথে যে সংগ্রামের সূচনা করেছিল তা রাজপথে সংগ্রামের মাঝ দিয়েই ফয়সালা হয়ে যেত। ‘৬৯ পূর্ব বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ তার মুক্তির চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েমের কথা উচ্চারণ করেছিল, যদি সেই পথ ধরে এদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হত তাহলে গণযুদ্ধের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্র কায়েমের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়। রাজপথে আন্দোলনের মাঝে যে আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট রচনা হচ্ছিল তাকে নিয়ে যাওয়া হল গোলটেবিলের সংকীর্ণ চৌহদ্দীতে। কারণ ’৬৯ এ যে চেতনা পরীক্ষিত হয়ে একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে এদেশের পুঁজিপতিরা শংকিত হয়ে পড়ে। তাদের ধারণা এ পথে আন্দোলন এগোলে জনগণ ক্ষমতা দখল করবে। আর তাই সেদিন আপোষ ফর্মুলা হিসাবে বেছে নেয়া হল ভোটের পথ। ভোটে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান এবং সমগ্র পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন অখন্ড পাকিস্তান রাখতে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক আমলাদের একগুঁয়েমির জন্য তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতা হারান। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ পূর্ব পর্যন্ত এটিই ছিল বাস্তবতা। যদি তাই না হত তাহলে সারাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই ব্যাপক গণহত্যা অনেকাংশে রোধ করা যেত। তাহলে অপ্রস্তুত জনতাকে তোপের মুখে রেখে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারত না, অথচ তারা সেটা করেছে। কোন্ আশায় ভারতে আশ্রয় গ্রহণ? ভারত কি একটি গণতান্ত্রিক মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া মুক্ত স্বাধীন দেশ? এ সত্ত্বেও এদেশের সাধারণ সিপাই-পুলিশ-ইপিআর-আনসার জনতাকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু বিপ্লবীদের সক্রিয় ভূমিকার দূর্বলতা ও প্রবাসী আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় ভারতীয় বুর্জোয়া প্রচারযন্ত্রের প্রচারণার ফলে জনগণের মুক্তির সংগ্রাম বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারতের শাসকগোষ্ঠী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে ব্যবহার করে সাহায্যের হাত বাড়াতে মূহুর্তমাত্র দেরী করেনি।

২৫ শে মার্চে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের ভারতে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ পাকিস্তানী হামলার মুখে তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চাদপসরণ নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত তা আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মতই সত্য। জনগণকে না জানালেও আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করে কোথায় কিভাবে আশ্রয় নিতে হবে তার একটি নীল নক্সা প্রণয়ন করেই রেখেছিল। আশ্রয়ে থেকে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ প্রচারণার মাধ্যমে আবার সেই সংগ্রামকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করে। লেখার শুরুতেই যে কথা বলা হয়েছিল তাহলো আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি তথা সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা থেকে মুক্তির যে লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। তাহলে এখন যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো তাহলো ‘৭১ এ যে যুদ্ধ হল সে যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী মুক্তির লড়াই ছিল না। তাহলে প্রশ্ন আসে গ্রামে-গঞ্জে-কলকারখানায় কি শ্রমিক অস্ত্র ধরেছিল? হ্যাঁ ধরেছিল তার মুক্তির আশায়, কিন্তু নেতৃত্ব ছিল সাম্রাজ্যবাদের দালালদের হাতে। আর তাই ভারতের মত একটি দালাল পুঁজির দেশ বাংলাদেশের সেই মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। ভারত তার শ্রেণী স্বার্থেই এটি করেছিল। বাংলাদেশের মত একটি সম্ভাবনাময় দেশকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে পেলে একদিকে এটি একটি বাজার-আবার সামরিক দিক থেকেও সুবিধা। এ জন্যই একাত্তরের যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে দিল সাহায্য। যদি এটি মুক্তি সংগ্রামই হত তাহলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসত বিপ্লবী সরকার, কিন্তু দেখা গেল সে স্থলে ক্ষমতায় বসল পাকিস্তান সংবিধান এর আওতায় এবং নির্বাচনী তফসীল মেনে নিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ যারা জনগণের রায় নিয়েছিলেন অখন্ড পাকিস্তানের- তারাই বসলেন বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায়। এ থেকে বড় প্রমাণ আর কি আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক প্রতারণার?
যে পথে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না জেনেই শেখ মুজিব তাঁর ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করে এদেশের প্রগতিশীল শক্তির ওপর প্রচন্ড আঘাত হানেন। কারণ তিনি জানতেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিই একমাত্র স্বাধীন জাতীয় মুক্তির আশ্বাস দিতে পারে অন্য কেউ নয়। তাই সন্ত্রাস দমনের নামে পাকিস্তানী বাহিনীর কায়দায় গণহত্যা শুরু করেন। সেদিনের প্রগতিশীল শক্তিকে আতœপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেননি তিনি, পরিবর্তে লেলিয়ে দেন যুদ্ধবাজ রক্ষীবাহিনী যা আজও সারা দেশে এক আতংঙ্কের নাম। অথচ সাধারণ ক্ষমার নামে মুক্তি দেয়া হল চিহ্নিত খুনী, লুটেরা, নারী ধর্ষণকারীদের। এই সাধারণ ক্ষমা সাধারণ ক্ষমা নয়, শ্রেণী স্বার্থে বন্ধুদের মুক্তি। রাজাকার, আলবদর শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমা পেলেও ক্ষমা পাননি সিরাজ শিকদার, আমজাদ, ওয়াজেদ, দীপু, তারু সহ ৩০ হাজার দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মী। কেন রেহাই পাননি এঁরা শেখ মুজিবের অত্যাচার থেকে? কারণ এরা চেয়েছিলেন শত বৎসরের লালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়িত করতে। অন্যদিকে শেখ মুজিবের যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার সাথে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের কোনই মিল নেই। জনগণের মুক্তি এলে সৃষ্টি হতো না স্বৈরাচার, আসত না সামরিক শাসন, ঘটত না মৌলবাদের বিস্তার।

অতএব একথা সত্য শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির যে আকাঙ্খা যার জন্য লড়াই চলেছে শত শত বৎসর ধরে সেই শোষণহীন সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাই হচ্ছে ‘স্বাধীনতার চেতনা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ যে চেতনাকে বরাবার বিভ্রান্ত বিকৃত করা হয়েছে শোষিতের সংগ্রামী চেতনা এবং ক্ষোভকে ব্যবহার করে। আজ আবার এসেছে সেই চেতনাকে সঠিক পথে চালিত করে শ্রেণী সংগ্রামের চেতনাকে শাণিত করে কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার কর্তব্য। এর ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে মুক্তি পাবে শোষিত শ্রেণীসহ অপরাপর শ্রেণী এবং জাতিসত্ত্বাসমূহ। কবর রচনা করবে মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদের, এর কোন বিকল্প নেই। দেশের মানুষ রক্ত ঘাম দিয়ে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যে ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান দিতে পারেনি এদেশের মানুষের মুক্তি, মুক্তি দিতে পারেনি বাঙালী কিংবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা। অতএব ধর্ম ভিত্তিক কিংবা জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষের মুক্তি দিতে পারে না, পারে না গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, নিশ্চিত করতে পারে না মৌলিক অধিকারসমূহকে যার কারণে বার বারই ঘুরে ফিরে আসছে সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। আর এই ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী জনগণের মুক্তির সংগ্রাম। এটা ইতিহাসের দাবি।

© সাপ্তাহিক সেবা পাঠক ফোরাম
রুশ বিপ্লব বার্ষিকী সংখ্যা, ১৯৯৩

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ