বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আহমদ ছফা , একাধারে একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন। অনেক গবেষকদের মতে, কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা।তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে রচিতবুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্নরূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেন।

আহমদ ছফা তাঁর বিখ্যাত “বাঙালি মুসলমানের মন” প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদ্গামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন।
ডঃ আনিসুজ্জামান বলেছেন , ছফার বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধসংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য।মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনীকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে ছফার ওঙ্কার বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি।পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎপ্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন।

আহমদ ছফা ও তাঁর রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর, ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম এস এম সুলতান, হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ,সলিমুল্লাহ খান।

জীবিত কালে আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমীর সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।

আহমদ ছফা ৩০ জুন ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শামসুল আরেফীন রচিত আহমদ ছফার অন্দরমহল গ্রন্থে প্রকাশিত ১৯৫৬ সালে দশম শ্রেণীতে থাকাকালে আহমদ ছফার প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষার ইংরেজি ২য় পত্রের রেজাল্ট শীট
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন।১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন।
পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।

আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন

আহমদ ছফা ২৮ জুলাই ২০০১ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ